মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন সময়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প এবং ভাসানচরে অবস্থান করছে। তখন থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে।
কিন্তু প্রায় ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের নাগরিকদের সেদেশে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক মহলের কোনো সদিচ্ছাও দেখা যাচ্ছে না। বরং জাতিসংঘের বিশেষ দূত অলিভিয়ার ডি শুটার সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত, রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী খুব শিগগিরই ‘নতুন ফিলিস্তিনিতে’ পরিণত হতে পারে।
তিনি আরও বলেছেন, ক্রমহ্রাসমান আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর তাদের নির্ভরশীল হতে বাধ্য করাটা মোটেও স্থিতিশীল নয়। ফলে জনাকীর্ণ শিবিরে থাকা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়দানকারী দেশ বাংলাদেশে কাজ করার অধিকার দেওয়া উচিত। তার এ কথার প্রতিফলন দেখা গেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সাম্প্রতিক ঘোষণায়। বলা হয়েছে, তহবিল সংকটের কারণে ১ জুন থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৮ ডলার করা হবে।
জাতিসংঘ দূতের মন্তব্য আমাদের আশ্চর্যান্বিত করেছে এ কারণে যে, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়ন পুরো বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করেছিল। সেসময় জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতে একটি গণহত্যা মামলাও করা হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি এসেছিল, যত দ্রুত সম্ভব তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন তো ঘটেইনি বরং
আন্তর্জাতিক দাতারা এখন নানা সংকটের কারণ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। সাহায্য-সহযোগিতার পরিমাণও কমিয়ে দিচ্ছে। উলটো তাদের এখন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এর পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। কারণ আমরা দেখেছি, দেশের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে খুন-অপহরণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শরণার্থীবিষয়ক কোনো আইন বা কনভেনশনে অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র নয়। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসাবে গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিতেও বাধ্য নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। কেবল মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভূখণ্ডের আয়তনের তুলনায় এমনিতেই বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি।
এত বিপুল জনসংখ্যার চাপ থাকা সত্ত্বেও সরকার মানবিক কারণে যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। অনেক উন্নত দেশও ভূখণ্ড ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এতটা উদারতা দেখায় না। দেখালেও তা হয় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।
বর্তমান বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে যদি রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারকে বোঝাতে কিংবা চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না। তবে তেমন পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই জাতিসংঘের উচিত হবে এই জনগোষ্ঠীকে বিশ্বের অন্য কোথায় স্থানান্তর করা এবং সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।