মনজু আরা বেগম :
প্রতিবছরের মতো এবারও ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থার কারণে এবারের বাজেট কেমন হতে যাচ্ছে এ নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল কাজ করছে। জানা যায়, এবারের বাজেটে অধিক সংখ্যক মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ আছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। আসছে অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে ৬ লাখ কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে। এ বছর প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১ মে বাজেট বৈঠকে দেশে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথমত, সরকারি ব্যয়ে কঠোরভাবে কৃচ্ছ্রসাধন, এডিপি বাস্তবায়নের হার বাড়াতে মনিটরিং বৃদ্ধি করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা, হুন্ডি প্রতিরোধ করে বৈধপথে রেমিট্যান্স বাড়ানো এবং গ্রামীণ উন্নয়নে গুরুত্ব প্রদান। রিজার্ভ সংকটের কারণে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে আগামী বাজেটের প্রাক্কালে এ বিষয়গুলোর ওপর তিনি গুরুত্ব প্রদান করতে বলেছেন, যা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। কিন্তু দেশে প্রধান সমস্যা-দুর্নীতি, যার কারণে দেশের উন্নয়নমূলক অনেক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে সময়ক্ষেপণ করে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে, তা কীভাবে আদায় করা হবে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজার পরিস্থিতির ক্রমাগত যে অবনতি ঘটছে, তা কীভাবে রোধ করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে- সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। তিনি বলেননি, দেশে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ কীভাবে সৃষ্টি হবে। বলেননি, দেশ থেকে পাচারকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের কথা। জানা যায়, দেশ থেকে বছরে ৭৮ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে ২য় অবস্থানে রয়েছে। বিপুল পরিমাণ এ টাকা ফিরিয়ে আনতে পারলে আমাদের অর্থনীতির ভিত আরও মজবুত অবস্থানে গিয়ে দাঁড়াবে।
গত ৫০-৫২ বছরে আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দেশ আরও অনেকদূর এগিয়ে যেত কিন্তু দুর্নীতি আমাদের পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বাজার পরিস্থিতির অবনতির ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব পণ্য আমদানি করতে হয় সেগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাবে এটা স্বাভাবিক; কিন্তু দেশে যেগুলোর উৎপাদন হচ্ছে, বিশেষ করে কাঁচা শাকসবজি, তরিতরকারি-এগুলোর দাম প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে কেন? আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি হলেও সে পেঁয়াজ আমরা কিনছি ৯০ টাকায় (যদিও এ হিসাব রাতারাতি পালটে যাচ্ছে)। মন্ত্রিসভার একজন সদস্য বলেছেন, ‘মানুষ বাজারে গিয়ে কাঁদছে। মন্ত্রীদের মধ্যেই সিন্ডিকেট আছে।’ যারা সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে ভোট নিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন, তারাই সিন্ডিকেট করে বাজারকে অস্থির করে মানুষকে কাঁদাচ্ছেন। জীবনযাত্রাকে অস্বাভাবিক করে তুলেছেন। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন? হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোরব্যবস্থা নিয়ে এবং দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারলে দেশের অর্থনীতি অনেকটা চাঙা যাবে। মানুষের দুর্ভোগ কমে যাবে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলবে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবে। দেশে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন তারা আবার কাজে যোগ দিতে পারবেন।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে দেশে সাড়ে চার কোটি মানুষ বেকার; কিন্তু সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা বলা হচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তির ওপর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৭ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৮২ লাখ এবং নারী ২ কোটি ৫৪ লাখ। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি। এর কারণ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে অনেকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায়, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে চাকরি হচ্ছে না। দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়ছে না। বলা যায়, ক্রমাগত কমছে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। এর সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ না বাড়ালে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে এ জনশক্তি পরিবার ও সমাজে সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এদের কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? দেশে অর্থনীতির আকার বড় হলেও বা মাথাপিছু আয় বাড়লেও আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য দূর করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স নীতি’র ঘোষণাকে কার্যকর ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আসছে বাজেটে করজালের আওতা বাড়াতে হবে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১ কোটি মানুষও কর দেন না। যাদের কর দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে তাদের অনেকে অসদুপায় অবলম্বন করে কর ফাঁকি দেন। এজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান এনবিআরকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কর আদায়ে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সরকারি সংস্থা ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ রয়েছে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটি মূলত অকার্যকর বলা যায়। একদিকে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার, অন্যদিকে ভেজালে সয়লাব বাজার। খাদ্যদ্রব্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, প্রসাধনীসহ এমন কোনো পণ্য নেই যাতে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে না। চড়া দামে হলেও কিনে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খেয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা করতে গিয়ে একদিকে সর্বস্ব হারাচ্ছেন, অন্যদিকে অনেকে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, চরম জনবল সংকটে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। রাজধানীতে প্রায় ২ কোটি ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় বাজার তদারকি করছেন মাত্র ৫ জন কর্মকর্তা, যা একেবারেই অসম্ভব। পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও অসাধু চক্র বা সিন্ডিকেট বিভিন্নভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনজীবনকে অস্থির করে তুলেছে। এজন্য এ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে বাজেটে জনবলসহ প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং উদ্যোক্তাদের মতে, দেশে শিল্প স্থাপন করা বেশ জটিল। আমলাতন্ত্র, আইনি জটিলতা, চাঁদাবাজি, অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে শিল্প স্থাপন দুরূহ হয়ে পড়েছে। উদ্যোক্তাদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। এতে সময় ও অর্থব্যয় বেশি হচ্ছে। ফলে মুনাফা কম হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করলে এতবেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না।
স্বল্প সময়ে বেশি মুনাফা পাওয়া যায় বলে উদ্যোক্তাদের একটি অংশ ট্রেডিং ব্যবসার দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এতে ট্রেডিং ব্যবসার প্রসার ঘটছে এবং শিল্পের বিকাশ কম হচ্ছে। (যুগান্তর, ২০.০৫.২৩)। দেশে বড় সংখ্যক প্রবীণ জনগোষ্ঠী রয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে আমাদের গড় আয়ু বৃদ্ধি হওয়ায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৩ লাখ। এদের অধিকাংশই পরিবার ও সমাজে অত্যন্ত নির্যাতিত ও নিগৃহীত। ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার প্রবীণ নীতিমালা এবং পিতামাতার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করলেও গত ১০ বছরে এ আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি, আবেদন-নিবেদন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে বাজেটে ‘বয়স্ক ভাতা’ নয়, প্রবীণদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখার পাশাপাশি উল্লিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
monjuara2006@yahoo.com