শনিবার, ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -১.৬৪°সে

প্রায় ২০০ বছরের পুরাকীর্তি, নান্দনিক সৌন্দর্যে ঐতিহাসিক বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া জামে মসজিদ

মনির হোসেন:
বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমপ্লেক্স প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এ মসজিদটিতে বর্তমানে নতুন রূপ নিয়েছে। মসজিদের পাশে রয়েছে হেফজখানা । এই হেফজখানা নাম হচ্ছে বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া আশ্রাফিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা যেখানে গেলেই দিন রাত শোনা যায় পবিত্র কোরআনের ধ্বনি।
বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সামনে নান্দনিক সৌন্দর্যের পুকুরটি কাছে দাঁড়িয়ে মসজিদের সৌন্দর্যের উপভোগ করা যায়। মসজিদের কাছে আসলে সেই ২০০ বছরের পুরাতন তিনটি মিনার দেখা যায়। মসজিদের প্রবেশ করতে বিশিষ্ট নান্দনিক সৌন্দর্যের গেট রয়েছে। যা এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীদের মুগ্ধ করে। মসজিদটির সামনে দিয়ে একটি পাকা সড়ক। তারপর মসজিদ বরাবর সোজাএকটি পুকুর। মসজিদের দুই পাশে রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান। উত্তর পাশে কবরস্থানটি অনেক গুলো আম গাছ যেন মসজিদ থেকে বের হলেই মুসল্লিদের ছায়া দিচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে এ মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন মুসল্লিরা।


নতুন মসজিদের পাশাপাশি প্রাচীন আমলের এ মসজিদটির ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে কুমিল্লা নগর জুড়ে। অনেকে মনে করছেন, ইতিহাস ঐতিহ্যের এক অন্যান্য নিদর্শন হতে পারে বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমপ্লেক্সটি।
বর্তমান মসজিদ কমিটির হিসাবরক্ষক ছালেহ আহাম্মদ মসজিদের ইতিহাস বের করার জন্য দীর্ঘ সময় কাজ করে একটি তথ্য মূলক লিফলেট মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান , সি.এস খতিয়ানে উক্ত ১৯৯ নং বিষ্ণুপুর মৌজার সি.এস দাগ নং-৩২, ৩৩ ও ৩৪ দাগ সহ অন্যান্য দাগের প্রকৃত মালিক ছিলেন শ্রী শ্রীযুত রাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুর। তিনি ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার বর্তমান কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত কোতয়ালী থানার চাকলা রোশনাবাদ মেহেরকুল পরগণার জমিদার সাহেব। তখন ১৭৯০ খ্রিঃ সাল বৃটিশ আমল, দেশটি ছিল ভারত উপমহ্যাদেশ না ভারতবর্ষ। বর্তমানে বাংলাদেশ, শাকিস্তান, ভারত মিলে এই উপমহাদেগাটি ছিল । উক্ত রোশনাবাদ মেহেরবুল পরগণার জমিদার শ্রী শ্রীযুত রাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুর তৎকালীন কুমিল্লা রেইসকোর্স এলাকায় অবস্থিত ঘোড় দৌড় মাঠে এক ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় আয়োজন করেন। ঐ ঘোড় দৌড়ে অন্যান্য প্রতিযোগির সঙ্গে এক মুসলিম দরবেশ শাহ সুফী মৌলভী আশরাফ (রহ.) অংশগ্রহন করেন এবং উক্ত ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম বিজয়ী হিসেবে দরবেশ শাহ সুফী মৌলভী আশ্রাফ (রহ.) কে বিজয়ী পুরষ্কার হিসেবে বিষ্ণুপুর মৌজার উক্ত সম্পত্তি সহ আরো অন্যান্য সম্পত্তি তৎকালীন রাজা সি.এস ১নং খতিয়ানের প্রকৃত মালিক শ্রী শ্রীযুত রাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুর দরবেশ শাহ সুফী মৌলভী আশরাফ (রহ.) এর নামে মৌখিক দান করে দেন। তারপর শাহ সুফি মৌলভী আশ্রাফ (রহ.) সি.এস ৩৩ আর.এস ৫৫ এবং বি.এস ৬৩ দাগে এক একর চার শতক ভূমিতে এলাকার জন সাধারণের খাওয়ার ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি পুকুর খনন করেন। পুকুরটি খনন করে পুকুরের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম পাড়ের আংশিক সি.এস ৩২, আর.এস ৫৩, বি.এস ২৮ এবং ৪৩, ৬৪, ৬৫ ৩ ৬৬ দাগের ৭৮.৬৩ শতক ভূমিতে এলাকার জনসাধারণের জনহীতকর কাজে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। যাহার কোনো ডুকুমেন্ট কারো কাছে রক্ষিত না থাকলেও অতিতের সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।


তারপর ১৮০৪ খ্রিঃ ৩রা ফেব্রুয়ারী রোজ শুক্রবার উক্ত মসজিদ এর নির্মাণ কাজ আরম্ভ করে ১৮০৪ সালের নভেম্বর মাসের ভিতরে উক্ত নির্মাণ কাজ শেষ করেন। (সি.এস ৩৪, আর.এস ৫৪ এবং বি.এস ৬২ দাগে) ০৯ শতক ভূমিতে নিজ খরচে নিজ জায়গায় ইট তৈরী করে পুড়িয়ে চুন, সুরকির তিন গম্বুজ বিশিষ্ট কারুকার্য খচিত সৌন্দর্যমন্ডিত একটি জামে মসজিদ ও মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে মুসুল্লিদের ওজু করার জন্য একটি ঘাটলা নির্মান করে উক্ত মসজিদে ০৫/১২/১৮০৪ খ্রিঃ মোতাবেক ১লা রমজান রোজ বুধবার ১২১৯ হিঃ ফজরের নামায থেকে উক্ত মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা শাহ্ সুফী মৌলভী আশ্রাফ (রহঃ) এর ইমামতিতে জামাতে নামায পড়া শুরু হয় এবং উক্ত মসজিদের আশেপাশের এলাকা এবং পুকুরটি সহ জনসাধারণের জন্য ধর্মীয় এবং সমাজের হিতকর কাজে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত এবং মৌখিকভাবে লিল্লাহ ওয়াকফ করে দেন।
আরো জানা গেছে, তখন ছিল ১৭৯০ইং সাল বৃটিশ আমল তখনো সি.এস ম্যাপ তৈরী হয়নি অর্থাৎ ভূমির দাগ নাম্বার সৃষ্টির আগে। বর্তমান বিষ্ণুপুর মৌলভী পাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। প্রতিষ্ঠারও ১৪ বছর আগে এবং পুকুর খননের আগে পুকুরের স্থানে অর্থাৎ বর্তমান মসজিদের পূর্ব পাশে এশটি বৃহতাকারের বট গাছ ছিল উক্ত বটগাছ এর নিচে তৎকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন উক্ত বটগাছকে পুজা দিত এবং উক্ত বটগাছের তলায় ও আশেপাশের স্থানে বৈশাখী মেলা হতো। তখন উক্ত এলাকার নাম বিষ্ণুপুর বটতলা ছিল। তারপর ১৮০৪ ইং সালে উক্ত স্থানে জামে মসজিদটি নির্মান করার পর উক্ত এলাকার নাম বিষ্ণুপুর বটতলা থেকে দরবেশ শাহ সুফি মৌলভী আশ্রাফ (রহ) (বুড়া মৌলভী সাহেব) এর নামে নামকরণ করা হয়। সেই (১৮০৪ ইং) সাল থেকে এই এলাকার নাম বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া নামে পরিচিত। অতীতে ও বর্তমান সময়েও ঐ দরবেশ শাহ সুফি মৌলভী আশ্রাফ (রহ) এর কোন বংশধর ও দাবীদার পাওয়া যায়নি। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, দরবেশ শাহ সুফি মৌলভী আশ্রাফ (রহ) অবিবাহিত অবস্থায় ওফাত বরণ করেন এবং মসজিদের দক্ষিণ পাশে ও মসজিদ সংলগ্ন পুকুরের পশ্চিম পাড়ের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। কিন্তু উনার কবরের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।


এছাড়া আরো জানা যায় যে, তিনি সুদূর ইয়েমেন দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন। তিনি ফার্সি ভাষায় পারদর্শী, শিক্ষিত, বুজুর্গ এবং ইসলাম ধর্মের ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিঃস্বার্থবান, পরোপকারী, দানবীর এবং সৎলোক ছিলেন। দরবেশ শাহ সুফি মৌলভী আশ্রাফ (রহ) কর্তৃক নির্মিত বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া কেন্দ্রীয় মূল জামে মসজিদের প্রধান দরজার উপরে ফার্সি ভাষায় তাহার নাম ও মসজিদ প্রতিষ্ঠার সন লিপিবদ্ধ আছে।
মসজিদটি সম্পর্কে বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি হাজী শাহ্ আরশাদুল হক বিল্লাল বলেন, বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি অনেক পুরানো মসজিদ। এটা ১৮০৪ সালে নির্মাণ করা হয়। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা করেন হযরত মৌলভী আশরাফ(রঃ)।
তিনি আরও বলেন, মসজিদটি সেই ২০০ বছরে তৈরি করা সামনের অংশ ঠিক রেখে চার তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বর্তমানে দুইতলা করা হয়েছে। ১৮০৪ সালের দিকে এ অঞ্চলে আর মসজিদ ছিল না। আমরা জানতে পেরেছি, বিষ্ণুপুর, ভাটপাড়া, কালিয়াজুড়ি, কাপ্তানবাজারসহ আশে পাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে সে সময় মুসল্লিরা নামাজ পড়তে আসতেন এ মসজিদে।
তিনি আরো বলেন, বিষ্ণুপুর মৌলভীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমপ্লেক্সটি কুমিল্লার মধ্যে অন্যতম পুরাতন মসজিদ। এ মসজিদে প্রায় ১ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটিতে পাশে একটি হেফজখানা রয়েছে। যেখানে ছাত্ররা পবিত্র কোরআনের হাফেজ হচ্ছেন। এ এলাকার মুসলমানদের প্রাচীন এ ইবাদতখানাটির আধুনিকায়ন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে সাধরন মানুষের দৃষ্টিনন্দন করেছেন।
মসজিদের সভাপতি শাহ্ আরশাদুল হক বিল্লাল আরো বলেন,মসজিদের চারপাশে আরো কিছু অসমাপ্ত কাজ রয়েছে। বর্তমানে কমিটিতে ২৭ জন সদস্য নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। মসজিদের উন্নয়নের জন্য আরো ধর্ম প্রাণ মুসল্লিাদের সহযোগিতা কামনা করেন।


এদিকে মসজিদটি ঘুড়ে দেখা যায়,পুকুরে যেমন অজু করা যায় তেমনি ভেতরেও রয়েছে অজুর ব্যবস্থা। দিনের ৫ বার ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি দুই ঈদ, শবে বরাত, শবে কদরসহ অন্যান্য বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় দিনগুলোতে এখানে আয়োজন করা হয় বিশেষ জামাতের। নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতে কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে শক্তিশালী জেনারেটর। বিদ্যুৎ চলে গেলেও তাই আলো হীন হয়ে পড়ে না মসজিদ কমপ্লেক্স। মসজিদটিতে ধর্মীয় দিনগুলোতে রাতে যখন আলোকসজ্জা করা হয় তখন বিমুগ্ধতায় ছাওয়া এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি হয়। যে পরিবেশে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সৎ পথে চলতে। সততা আর বিবেক দিয়ে গড়তে নতুন জীবন।

 

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

গাইবান্ধায় বিএনপি-জামায়াতের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, আহত-১৪
রাখাইনে গুরুত্বপূর্ণ সেনা দপ্তর দখল করলো আরাকান আর্মি
আমরা আল্লাহর ওপরে ভরসা করি, হাসিনার ভরসা ভারত: দুলু
১৯ নাবিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
১৯ নাবিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
ঢাকায় রাহাত ফতেহ আলী খান, মঞ্চ মাতাবেন রাতে

আরও খবর