অনলাইন ডেস্ক :
৬৪ বছর বয়সে গত বৃহস্পতিবার চাকরিতে যোগদানের চিঠি পেলেন দীনবন্ধু ভট্টাচার্য। তার মতো আরও ৬৬ জন আছেন। এখন তাদের অবসরের বয়সসীমাও পেরিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে চারজন এখন আর বেঁচে নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ৪০ বছর পর তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের এ চিঠি পেলেন।
দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরির জন্য পশ্চিমবঙ্গের হুগলির দীনবন্ধু ভট্টাচার্য আবেদন করেছিলেন। সেই সময় তিনি যুবক। অনেক দিন পর গত বৃহস্পতিবার চাকরিতে যোগদানের চিঠি পেয়েছেন তিনি। এখন তার বয়স ৬৪।
৪০ বছর আগে (১৯৮৩ সালে) প্রাথমিক শিক্ষকের পদে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন দীনবন্ধু ভট্টাচার্যসহ অনেকে। ফলাফল প্রকাশের পর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকের নিয়োগ হয়নি বলে সেই সময় অভিযোগ ওঠে, মামলাও হয়। অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর চাকরিতে যোগদানের সেই চিঠি এলো গত বৃহস্পতিবার।
দীনবন্ধু ভট্টাচার্য বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকের জন্য যখন পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তখন আমি যুবক। চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে এখন আমার বয়স ৬৪। হাতে নিয়োগপত্র পেয়েছি। আমি একা নই, আমার মতো ৬৬ জন এমন চিঠি পেয়েছেন। এর মধ্যে তো চারজন বেঁচেই নেই।
চিঠি হাতে দীনবন্ধু ভট্টাচার্য গিয়েছিলেন বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসে। তার মতো নিয়োগপত্র পাওয়া অনেকেই সেখানে গেছেন চিঠির ‘মর্মার্থ বুঝতে’।
১৯৮৩ সালে শিক্ষক নিয়োগের চাকরির পরীক্ষা দেন দীনবন্ধু ভট্টাচার্য, অচিন্ত্য আদক, কালীধন বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকেই। পরীক্ষার পর সাক্ষাৎকার হয়েছিল ওই বছর। ফলাফল প্রকাশের পরই সেই ফল বাতিল হয়। অনেকেই আদালতের দ্বারস্থ হন। নিয়োগসংক্রান্ত সেই মামলা কলকাতা হাইকোর্টে চলছিল। ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেন আদালত। নিয়োগসংক্রান্ত মামলাটি যখন দায়ের হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার।
এখন তৃণমূল ক্ষমতায়। গত কয়েক বছরে শিক্ষক নিয়োগ, পৌরসভায় নিয়োগ, রেশনসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে খবরের শিরোনাম হয়েছে রাজ্যটি। নিয়োগের দাবিতে রাস্তায় বসে আন্দোলন করছেন নবম-দশম এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীরা।
কালীদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষক নিয়োগের চিঠি পেয়েছেন হুগলি জেলা পরিষদের কাছ থেকে। তিনি বলেন, আমার বয়স তখন ২৭-২৮ বছর। প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারের পর আমাদের নির্বাচনও হয় কিন্তু সেই প্যানেল বাতিল হয়ে যায়। আমরা সে বছরই আদালতে মামলা করি। সবকিছু বিক্রি করে মামলা চালিয়েছি।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যে নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহন দাস পণ্ডিত বলেছেন, ১৯৮৩ সালে জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং দেওয়া হতো। রাজ্যজুড়ে এই সময় যে নিয়োগ হয়, তখন কেউ কেউ চাকরি পেয়েছেন আবার কেউ পাননি। সেই সময় নিয়ম ছিল, ৬০ শতাংশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেওয়া হবে, বাকি যাদের প্রশিক্ষণ নেই কিন্তু যোগ্য, তাদের নেওয়া যেতে পারে।
মামলাকারীদের দাবি ছিল যারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাদের সবাইকে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। এ দাবিতে তারা আদালতে মামলা করেন। ৩০ বছর পর ওই মামলার যে রায় বের হয় ২০১৪ সালে, সেটা রাজ্য সরকার মানতে চায়নি, তাই সেই মামলা আবার চলতে থাকে।
অবশেষে গত ২০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট নির্দেশ দেন চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের; কিন্তু রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানোই হয়নি আবেদনকারীদের বয়সসীমা ৬০ পেরিয়ে গেছে। চারজন এখন বেঁচে নেই।
মোহন দাস পণ্ডিতের প্রশ্ন, শিক্ষা দপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কিভাবে জেলা পরিষদ নিয়োগের চিঠি পাঠাল। রাজ্য সরকারের উচিত ছিল খোঁজখবর নিয়ে আদালতকে সঠিক তথ্য দেওয়া। তবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি হুগলি জেলা পরিষদের কেউ।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর নিয়োগের চিঠি পাওয়ার পর আক্ষেপ করে দীনবন্ধু ভট্টাচার্য বলেন, আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। চাকরির অপেক্ষা করতে করতে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। মামলা লড়তে আর অন্যান্য খরচ চালাতে গিয়ে আমাদের ১ বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন থাকি বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে। ভেবেছিলাম ছাত্র পড়াব, এখন লোকের জমিতে চাষ করে খাই। তবু আমরা অন্তত বেঁচে আছি, বন্ধুরা তো মরেই গেল।
হুগলি জেলা পরিষদের নিয়োগপত্র অনুযায়ী, এখন তার যোগ দেওয়ার কথা কাছের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, উমেশ তালুকদার, সাইদুল হালদার, স্বপন ঘোষসহ তিনজনকে হারিয়েছি।
নিজের আর্থিক অবস্থার কথা জানিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অচিন্ত্য হালদার। তিনি বলেন, খুব অভাবের সংসার। আমি আর আমার বউদি থাকি। দাদা চাকরি করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর খুব কষ্টে সংসার চলছে। মামলা চালাতে অর্থ গেছে, আর জীবনের অর্ধেকটা তো চলেই গেল। আমার বয়স ৬৮ পেরিয়েছে।