মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
মহানবি হজরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এ কথায় পৃথিবীবাসীর প্রায় সবাই একমত। আর তার পবিত্র জন্মও হয়েছে সম্পূর্ণ অলৌকিক পন্থায়। তার জন্মকে কেন্দ্র করে অনেক আশ্চর্যজনক কাজের জন্ম হয়েছে, যা সব জাতিকে বিমোহিত করেছে এবং তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বে তা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; সৃষ্টি হয়েছিল বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনারও। তাঁর পবিত্র জন্মের পর তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত কাবা শরিফ দুলতে থাকে।
এ দৃশ্য দেখে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা তথা গোটা আরব জাহানের মানুষ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারেন (সিরাতে হালবিয়া, নবি (সা.)-এর আবির্ভাব অধ্যায়)। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার স্মরণ সব জাতি সব যুগে করেছে। তিনি সেই মহামানব, যার নাম পবিত্র ইঞ্জিল ও তাওরাত শরিফে উল্লেখ আছে; সেখানে তাকে সম্বোধন করা হয়েছে ‘আহমদ’ নামে আর কুরআনে পাকে ‘মুহাম্মাদ’ নামে (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩২৪)।
মহানবি (সা.) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেন, সেই রাতে পারস্যের রাজপ্রাসাদে প্রবল ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়; যার ফলে তৎক্ষণাৎ সেই প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে পড়ে। এ নিদর্শনের মাধ্যমে তাদের ১৪ জন বংশধর ক্ষমতাবান হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করা হয়। আর এই ১৪ জনের মধ্যে পরবর্তী সময়ে মাত্র চার বছরে ১০ জন শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আর বাকি শাসকরা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর শহিদ হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।
মহানবি (সা.)-এর জন্মের দিন পারস্য তথা ইরানের আগুন নিভে যায়, যা হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত ছিল (বায়হাকি, দালাইলুন নবুয়্যাহ , খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১২৬)। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মহান আল্লাহর আমার প্রতি সম্মান হলো, আমি খাতনাবিশিষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছি। যাতে আমার লজ্জাস্থান কেউ যেন না দেখে’ (মু’জামে আওসাত, হাদিস নং ৬১৪৮)।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, যেহেতু নবি করিম (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন সেহেতু এ দিনটি ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। বিশেষত দুটি কারণে ১২ রবিউল আউয়াল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। প্রথমত সব ইতিহাসবিদের ঐকমত্য বর্ণনামতে, এ দিনেই মহানবি (সা.) পৃথিবীবাসীকে কাঁদিয়ে ওফাত লাভ করেন। দ্বিতীয়ত প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী এই ১২ রবিউল আউয়াল তারিখেই মহানবি (সা.) জন্মগ্রহণ করেন (সিরাতে ইবনে হিসাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৫৮)।
মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম তারিখ নিয়ে সবাই একমত যে রবিউল আউয়াল মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সোমবার দিন নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম হয়েছিল। এই সোমবার ৮ অথবা ৯ কিংবা ১২ তারিখ এটুকুতেই হিসাবের পার্থক্য রয়েছে মাত্র। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল থেকেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবি (সা.)-এর জন্মদিন হিসাবে পালন হয়ে আসছে। তবে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহানবি (সা.)-এর ওফাত দিবস এতে সব ঐতিহাসিকই ঐকমত্য পোষণ করেছেন (সূত্র ইসলামি বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
মহানবি (সা.) কেবল তার অনুসারীদেরই নন, জাতি-ধর্ম, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের আদর্শ ও পথপ্রদর্শক এবং তিনি বিশ্বমানবের মহান শিক্ষক ও অনুপম আদর্শও বটে। মানব ইতিহাসের এক যুগসন্ধিকালে, অন্ধকারতম সময়ে তিনি মহান আল্লাহর বাণী নিয়ে অবতীর্ণ হন। তাঁর উদাত্ত আহ্বান, নিষ্ঠাপূর্ণ কর্মসাধনা, উচ্চতম নীতি আদর্শ ও অমলিন পবিত্র-মাধুর্যের মাধ্যমে তিনি অল্প দিনে এক আলোকোজ্জ্বল ও সর্বোন্নত জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন। তিনিই অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং অনাচার, পাপাচার ও বিশ্বাসহীনতার কলুষ দূরীভূত করে শান্তি, সভ্যতা, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার এক নতুন পথ রচনা করেন। তিনি একাধারে একটি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, একটি জাতির নির্মাতা এবং একটি অতুলনীয় সভ্যতার স্রষ্টা। তাই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবি, সাইয়্যেদুল মুরসালিন ও খাতামুন নাবিয়্যিন।
আজকের বিশ্বসভ্যতা সবচেয়ে বেশি ঋণী ইসলাম ও মুসলমানদের কাছে। এ সভ্যতার যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু মঙ্গলজনক তার পেছনে রয়েছে মহানবি (সা.)-এর আদর্শ, শিক্ষা, নির্দেশনার অনিবার্য ভূমিকা। শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও মানবিক বিকাশের সব ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ অনস্বীকার্য।
বর্তমান বিশ্বে মানুষ যখন ধর্মবিমুখ, বস্তুবাদী দর্শনের কবলে পড়ে যুদ্ধ-সংঘাত-সন্ত্রাস ও অশান্তির অনলে পুড়ছে, যখন ক্ষমতা, সম্পদ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে নিজের সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করছে তখন একমাত্র ইসলাম ও বিশ্বনবি (সা.)-এর শিক্ষাই তাকে সর্বোত্তম সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট