তাসনিম জাহান তুলি:
বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ প্রাণঘাতী আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। যার ভয়াহবতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বজুড়েই চলমান। বাংলাদেশও এই মহামারি থেকে রেহাই পায়নি। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ (করোনা) এ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে সংক্রমণের সংখ্যা কেবল বাড়তে থাকে। মহামারির এই প্রকোপ এড়াতে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১ম দফায় সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। যা পরবর্তীতে দফায় দফায় বাড়িয়ে একটানা ৬৬ দিনের ছুটিতে গড়িয়েছিল। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পাশাপাশি এলাকা ভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করেছিল। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রেও ছিল কড়াকড়ি। দীর্ঘদিনের লকডাউনের ফলে দেশের যে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা দেখা দেয়, তা থেকে দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে, জনসচেতনতার কথা বলে গতবছরের ১ জুন থেকে সীমিত পরিসরে সকল প্রতিষ্ঠান চালু করে। স্বাভাবিক হতে শুরু করে নাগরিকদের জীবনযাত্রা। পরবর্তী ১০ মাস করোনা থেকে বাচঁতে, জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি মানতে বা মানানোর ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।
কোভিড-১৯ এর মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকার সকল শিল্পকারখানা, অফিস-আদালত, হাট-বাজার,গণপরিবহনসহ সকল কিছু নিয়ম মেনে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া থেকে বিরত ছিল। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে সাধারণ মানুষের অনীহা এবং করোনার প্রতি খামখেয়ালিপনার জন্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি শেষ সাপ্তাহ থেকে পুনরায় বাড়তে থাকে করোনার প্রকোপ। বিশেষজ্ঞরা করোনার দ্বিতীয় তড়ঙ্গ সম্বন্ধে বারবার সতর্ক থাকার কথা বললেও জনসাধারণ থেকে শুরু করে কেউই তা আমলে নেননি। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম দফার থেকেও মারাত্মক হতে পারে।
দেশে করোনা সংক্রমণের হার এখন আশংকাজনকভাবে উর্ধ্বমুখী। প্রতিদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে রেকর্ড পরিমাণে। আগে যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীর পরিস্থিতি জটিল হতে লাগতো ৮-১০ দিন, সেখানে কোনো লক্ষণ ছাড়াই এখন লাগছে ২-৩ দিন। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কাজে আসছে না করোনা সম্পর্কিত জাতীয় গাইডলাইন। বাহ্যিক অবস্থা ভালো হলেও এক্সরে বা সিটি স্ক্যান করে বোঝা যাচ্ছে কোভিড আক্রান্তের ফুসফুসের ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সংক্রমিত। পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ছিল বয়স্কদের। কিন্তু বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তের বড় অংশই তরুণ। হালকা জ্বরের পর তীব্র কাশি তারপর আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস, গত কয়েকদিন তরুণদের নিয়ে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে দেশের প্রায় সব করোনা চিকিৎসাধীন হাসপাতালগুলো।
সরকারি তথ্যমতে, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ৯ হাজারেরও অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে দেশে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৬ লক্ষাধিক। গেল মার্চের পূর্বে করোনা সংক্রামণের হার তুলনামূলক কম ছিল, কিন্তু মার্চের শুরু থেকে হঠাৎই করোনার সংক্রামণ আশংকাজনক হারে বাড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞরা করোনার এই হঠাৎ প্রকোপ বাড়াকে বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। প্রতিদিন করোনার এই সংক্রমণ যেমন বাড়ছে, তেমনি লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও।
সরকার করোনার এই প্রকোপ কমাতে এই প্রথম সারাদেশে ৫ এপ্রিল থেকে এক সাপ্তাহের জন্য লকডাউন কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্পকারখানা, জরুরিসেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে বলে জানানো হয়েছে। লকডাউনের কারণে শহরে থাকা মানুষজন ছুটছে গ্রামের পথে। তাদের বেশিরভাগই আবার মানছে না স্বাস্থ্য বিধি। এমনকি মুখে মাস্ক পড়তেও দেখা যাচ্ছে অনীহা। এদিকে রাজধানীতে বেশিরভাগ করোনা চিকিৎসাধীন হাসপাতালে রোগীদের পর্যাপ্ত আইসোলেশন বেডের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু করোনার চিকিৎসা দিয়ে প্রকোপ এড়ানো সম্ভব নয়, যেহেতু গণহারে করোনা প্রতিরোধক্ষম টিকাদান এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। তাই জনসাধারণ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি না মানলে, সচেতনতা না বাড়ালে কেবল হাসপাতালের সিট বাড়িয়ে করোনার এই মহামারির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।
এ বছরের শুরুতেই দেশে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার হিসাবে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ২৭ জানুয়ারিতে হলেও ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে চালু হয়েছিল গণটিকাদানের কর্মসূচি। ২৫ জানুয়ারি প্রত্যাশিত সময়ের আগেই ভারত থেকে এসেছিল অক্সফোর্ড অ্যাস্টাজেনেকার ৫০ লাখ ডোজ করোনার ভ্যাকসিন। ভারতের সাথে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিমাসে ৫০ লাখ করে ছয় মাসে ৩ কোটি ডোজ পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। ২৩ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় চালানে ২০ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসলেও মার্চে আসেনি কোন টিকা। এর বাইরে উপহার হিসাবে দুই দফায় ভারত থেকে মিলেছে ৩২ লাখ ডোজ। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে এসেছে ১ কোটি ২ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন। ভারত থেকে পরের চালান কবে আসবে তাও অনিশ্চিত। এখন পর্যন্ত ৬৮ লাখের বেশি টিকা নিতে ইচ্ছুক মানুষ রেজিস্ট্রেশন করলেও টিকা পেয়েছে ৫৪ লাখ। প্রথম ডোজ প্রাপ্তদের দ্বিতীয় টিকা দেওয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে ১ম ডোজ পাওয়া সকলের জন্য পরের ডোজটি সময়মতো পাওয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালেন্স কো ভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশের ৩ কোটি ডোজ পাওয়ার কথা। তবে সেই টিকাগুলো কবে এবং কিভাবে বাংলাদেশে আসবে তার কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত নয়।
সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সংক্রমিত ও চিকিৎসাধীন প্রাপ্ত বয়স্ক দের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন আনতে না পারলে বড় ধরনের সংকটে পড়বে কোভিড ব্যবস্থা। করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেকে নতুন করে করোনায় সংক্রামিত হচ্ছে, এমন কথাও শুনা যাচ্ছে। এবিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন ভ্যাকসিন নেয়া মানেই যে স্বাস্থ্য বিধি মানতে হবে না, তা নয়। ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে যে এন্টিবডি মানবদেহে তৈরী হয় তা করোনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
সাইপ্রাস, নিউজিল্যান্ড, জিব্রাল্টারসহ বিশ্বের প্রায় বেশ কয়েকটি দেশ করোনা ভ্যাকসিন নেয়া ও কড়াকড়ি স্বাস্থ্য বিধি মানার ফলে করোনা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় এবং সংক্রমণের হার এখন ১ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে উল্লেখিত দেশগুলোকে অনুসরণ করা গেলে আমাদের দেশেও কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করা যায়।
করোনা প্রতিরোধে টিকাকে মহামারি থেকে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছে। প্রতিকার প্রতিরোধ ছাড়া এই সংক্রমণ কমানো কোনভাবেই সম্ভব নয়। কোন অঞ্চলে করোনা সংক্রামণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সেই অঞ্চলের জনগনের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি কোনরূপ তোয়াক্কা না করাকে। আমাদের দেশে গ্রাম, শহর, উপশহর সবজায়গাতেই এখন স্বাভাবিক গণজামায়েত দেখা যাচ্ছে। বিবাহ, উৎসব, সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিকভাবেই চলছে। বর্তমান হাট, বাজার, রাস্তাঘাট , মার্কেট কিংবা দর্শনীয় স্থানগুলোতে অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক তো দেখা যাচ্ছেই না। অনেকে আবার করোনাকে রোগ হিসাবে মেনে নিতেও নারাজ। যার কারণে করোনার এই তীব্র প্রকোপ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে এবং পরপষ্পর থেকে অন্তত ৩ ফিট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে। কারণ করোনা ভাইরাস মারাত্মক ছোঁয়াছে এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যাক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। যেখানে মাস্ক পরিধান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে নিজের আবাসস্থলের সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বারবার সাবান-পানি বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। যেসব বস্তুতে অনেক মানুষের হাত লাগে যেমন- সিঁড়ির রেলিং,দরজা,পানির কল, গাড়ি এবং রিকশার হাতল ইত্যাদি ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাত পরিষ্কার করতে হবে। নিয়ম মেনে হোম কোয়ারান্টাইন পালন করতে হবে। মাছ- মাংস ভালো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে। অযথা ঘোরাফেরা ও আড্ডা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত বাহিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বাহিরে যাওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক ও গ্লাভস পরিধান করে বের হতে হবে। ঘরে ঢোকার পর অবশ্যই মাস্কটি ফেলে দিতে হবে কিংবা সেটি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। হাতের গ্লাভসটিও সাবান-পানি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
সর্বোপরি করোনার এই প্রকোপ এড়াতে ব্যক্তিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত দুই তৃতীয়াংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। একইসাথে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে মহামারিকে কেন্দ্র করে কেউ যেন ব্যক্তিস্বার্থে জনকল্যাণ পরিপন্থী কোন ক্রিয়াকলাপে যুক্ত না হয়। আসুন সকলে মহামারি প্রতিরোধে নিজে সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্য সূত্র-আজকালেরখবর