ডা. শাহজাদা সেলিম
ডায়াবেটিস রোগীর একটি অংশ সরাসরি প্যানক্রিয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেই রোগটিতে ভোগেন। অর্থাৎ প্যানক্রিয়াসের বিটাকোষ, যা ইনসুলিন তৈরি করে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ইনসুলিন উৎপাদন কমে যায় এবং ডায়াবেটিস হয়। এটিকে অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হারে এ রোগের উপস্থিতি দেখা যায়। তবে উন্নত দেশগুলোতে এ রোগ নেই বললেই চলে।
আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে প্রধানত বিষুবীয় এলাকা বিশেষ করে এ রোগের আধিক্য দেখা যায়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ যেমন- ত্রিপুরা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, তামিলনাড়ু, বিহার, মাদ্রাজ; বাংলাদেশের কিছু এলাকা এবং শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায় এ রোগের যথেষ্ট বিস্তার আছে। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে জিম্বাবুইয়ে, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় এফসিপিডির রোগী আছে। এ রোগটি সাধারণত বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোরে শুরু হয়।
ক্রনিক প্যানক্রিটাইটিসের লক্ষণ হিসেবেই এটি শুরু হয়। ক্রনিক প্যানক্রিটাইটিসের অন্যতম কারণ হলো- মদ্যপান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রোগটির কারণ শিশু বয়সে আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব। যা শরীরের অন্য অনেক অঙ্গের গাঠনিক অস্বাভাবিকতা তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয়েরও স্থায়ী কাঠামোগত দুর্বলতা তৈরি করে। ফলে অগ্নাশয় হতে নিঃসৃৃত আমিষ খাদ্যের পাঁচক রসটি (এনজাইম) আক্রান্ত ব্যক্তির অগ্নাশয়ের আমিষ উপাদানকেই হজম করতে থাকে। এ অংশটার সঙ্গে অগ্নাশয়ের বিটা কোষের সহাবস্থান। ফলশ্রুতিতে বিটা কোষের পরিমাণ কমতে থাকে – ইনসুলিন উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে এবং ডায়াবেটিস হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেহেতু পৃথিবীব্যাপী মানুষের পুষ্টির উন্নতি হয়েছে, এ রোগটির প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে। এ রোগটি অনেক ক্ষেত্রে জিনগত হতে পারে। রোগটি প্রথমত বয়ঃসন্ধিকালের কাছাকাছি সময়ে পেটের উপরের দিকে ডানপাশে অল্প-বিস্তর ব্যথা হিসেবে দেখা দিতে পারে; যা প্রথমদিকে গুরুত্বহীনভাবে দেখা হয়। কিন্তু ক্রমশ এর তীব্রতা বাড়তে থাকে এবং ঘন ঘন দেখা দিতে থাকে। প্রথমদিকে যেকোনো ব্যথানাশক ওষুধেই এ ব্যথা দূর হলেও পরের দিকে ব্যথা দূর করা অনেক কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াই। বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী যে কেউই এতে আক্রান্ত হতে পারে।
এফসিপিডিতে আক্রান্ত রোগীদের চেহারা ছবিতে তীব্র অপুষ্টির ছাপ থাকে। অর্থাৎ এরা সবাই ক্ষীণকায়া ও অস্বাস্থ্যকর ত্বকের অধিকারী। রোগটি শুরুর দিকে সামান্য গ্লুকোজ অসহিষ্ণুতা (প্রিডায়াবেটিস) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। রোগীর বয়স তৃতীয় দশকে পড়লে এদের অধিকাংশই পুরোপুরি ডায়াবেটিস রোগীতে পরিণত হয়।
অন্যান্য ডায়াবেটিস রোগীর তুলনায় প্যানক্রিয়াটিক ডায়াবেটিস রোগীদের কিছু স্বাতন্ত্র্য থাকে: ১. এটি প্রধানত শৈশব-কৈশোরে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২. অনেক রোগীই শুধু মুখে খাবার ওষুধ সেবন করেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন। ৩. এদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ৪. এরা অনেক দীর্ঘায়ু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
রোগটি শনাক্তকরণের জন্য রক্তের গ্লুকোজের অতিরিক্ত উপস্থিতি যেমন প্রমাণ করতে হবে; তেমনই অগ্নাশয়ের পাথরের উপস্থিতি অথবা অগ্নাশয়ের প্রধান নালিটি স্ফিত হওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে। এ জন্যে পেটের এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম এবং সিটিস্ক্যান সহায়ক পরীক্ষা পদ্ধতি হতে পারে। এ রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ কাঙ্ক্ষিত মাত্রাই রাখতে মুখে খাবার ওষুধগুলো বেশ কার্যকর। তবে অনেকেরই ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়। একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (হরমোন বিশেষজ্ঞ)- এর পরামর্শ রোগীর জন্য সহায়ক হবে। যেহেতু রোগীর অগ্নাশয়ে এনজাইম তৈরি করার অংশটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রোগীর সামগ্রিক পুষ্টিহীনতার প্রকট সম্ভাবনা থাকে। যা রোগীকে আজীবন ভোগ করতে হবে। ডায়াবেটিসের রোগীর দীর্ঘস্থায়ী সব জটিলতাই এদের ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করতে পারে।
বিশেষ করে ডায়াবেটিস কিডনি ডিজিজ, স্নায়ু রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি ইত্যাদি। কিছু কিছু রোগীর অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তাই এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে যত্নবান হতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।