অনলাইন ডেস্ক:
চট্টগ্রামে ইসকন কর্মীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ দেখে ৭ জনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার রাতভর বিভিন্ন স্থানে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে হত্যায় জড়িত সন্দেহে ২৭ জনকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
এ দিকে সাইফুল হত্যাকারীদের গ্রেফতার, দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে চট্টগ্রাম উত্তাল হয়ে ওঠে। নামাজে জানাজায় উপস্থিত সাধারণ মানুষ এ দাবি জানান। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে এই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন এই দাবিতে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি বিবৃতি প্রদান করেছে।
জামায়াত বলছে, অ্যাডভোকেট সাইফুলকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠ এবং আদালত ভবন চত্বরে নিহত সাইফুল ইসলামের দুদফা নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি জানাজাতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠের জানাজায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। আদালত চত্বরে নামাজে জানাজায় সহকর্মী শত শত আইনজীবী, বিচারক ছাড়াও সরকারের উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমেদসহ আলিফের সহকর্মী শত শত আইনজীবী ও বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন। জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে সাইফুলের নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন নগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী। লোহাগাড়ার চুনতিতে তৃতীয় দফা নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হন অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম।
মঙ্গলবার ইসকন নেতা ও সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ প্রভু ব্রহ্মচারীর জামিন না মঞ্জুর করায় মঙ্গলবার আদালত অঙ্গনে বিক্ষোভের নামে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় চিন্ময়ের অনুসারীরা। বিকালে তাদের হামলায় কোতোয়ালী থানাধীন রঙ্গম সিনেমা গলির মেথরপট্টি এলাকায় সাইফুল ইসলাম নিহত হন। তাকে একদল সন্ত্রাসী কুপিয়ে ও ইট দিয়ে মাথা ও চেহারা থেঁতলে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার পর মধ্যরাত পর্যন্ত নগরীর পাথরঘাটা মেথরপট্টি, আন্দরকিল্লা, হাজারী গলি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখে সরাসরি জড়িত ৬-৭ জনকে শনাক্ত করে পুলিশ। তার মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন কোতোয়ালী থানার ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরী। বুধবার দুপুর পর্যন্ত তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশের কাজে বাধা দান, যানবাহন ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে এরই মধ্যে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সব মামলায় গ্রেফতারকৃত ২১ জনকে গ্রেফতার দেখানো হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। অন্যদের হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হতে পারে।
খুনের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আসতেই হবে-উপদেষ্ঠা হাসান আরিফ: বুধবার সকালে আদালত চত্বরে নামাজে জানাজা শেষে উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, ‘যারা খুনের সঙ্গে জড়িত সে যেই হোক আইনের ঊর্ধ্বে কেউ না। আইনের আওতায় তাকে আসতে হবে। আমরা সংযত থাকব। আমাদের মধ্যে প্রতিহিংসা কাজ করবে না। কাজ করবে শুধু মহত্ব। আমরা শোকে ভেঙ্গে পড়ব না। শোকে আমরা স্টিলের মতো শক্ত হতে হবে। বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে যারা উঠে পড়ে লেগেছে, সে যেই হয়ে থাকুক আমরা প্রতিহত করব।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, উগ্রবাদী ইসকনের হামলায় তাদের প্রিয় সহকর্মী খুন হয়েছেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শোক সমাবেশে সারজিস-হাসনাত : নগরীর টাইগার পাশ মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা শোক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ইসকনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত বলেন, ‘আমরা ভুলে যাই নাই এই ইসকন কিভাবে গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠেছে। জঙ্গী সংগঠন হিসেবে স্বৈরাচারের সঙ্গী হয়ে ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, ভারতের বুবু, ভারতের হাসিনা এই বাংলাদেশে তোমার আর ঠাঁই হবে না। ভারতে বসে যতই ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হয় আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সেই ষড়যন্ত্র রুখে দিব। আমাদের দেশে সব ধর্মের সহাবস্থান থাকবে। যে হিন্দু সে হিন্দু ধর্ম পালন করবে। যে বৌদ্ধ সে বৌদ্ধ ধর্ম পালন করবে। যে খ্রিষ্টান সে খ্রিষ্টান ধর্ম পালন করবে। আমরা সবার অধিকার রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা উগ্রবাদী সংগঠন পরিচালনা করবে, সেসব উগ্রবাদী সংগঠনকে বাংলাদেশে কোনো জায়গা দেওয়া হবে না।’
ইসকনকে বিতাড়িত করা হাতের ময়লা উল্লেখ করে শোক সমাবেশের নাগরিক কমিটির সদস্য ও জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, ‘যে রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা এই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, যে রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ এসেছে, সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এই চিন্ময়রা উস্কানি দেয়। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে খুনি হাসিনারা উস্কানি দেয়। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে জঙ্গী ইসকনরা উস্কানি দেয়। সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের কিছু প্রেত্মা উসকানি দেয়। আমরা স্পষ্ট করে সব প্রেতাত্মাদেরকে বলে দিতে চাই, আমরা ১৬ বছরের খুনি হাসিনাকে দেশ ছাড়া করেছি এবং ছোটোখাটো কিছু জঙ্গী ইসকনকে দেশছাড়া করা আমাদের জন্য হাতের ময়লা।
এই বীর চট্টলায় খুনি ইসকনের জায়গা হবে না। বীর চট্টলাবাসী আপনাদেরকে বলে দিতে চাই আমাদের চারপাশে অনেক চক্রান্ত ছিল, আরও চক্রান্ত হবে কিন্তু আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সব চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে।’
আইনজীবী সমিতির কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি: সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি বুধবার কর্মবিরতি পালন করে। এ কারণে আদালত ভবনে কোনো বিচারক বিচার কার্য পরিচালনা করেননি। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে দোয়া মাহফিলের আয়োজনসহ আরও পাঁচ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক স্বাক্ষরিত এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে বিগত ২৬ নভেম্বর পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে উগ্রবাদী সংগঠন ইসকনের সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করেন। উক্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমিতির জরুরি সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তসমূহ হলো- সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালো ব্যাজ ধারণ করা, ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের সব আদালতের কার্যক্রমে কর্মবিরতি, আইনজীবী আলিফের আত্মার মাগফেরাত কামনায় বৃহস্পতিবার বাদ জোহর কোর্ট হিল জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল। এছাড়া আগামী ১ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় আইনজীবী দোয়েল ভবনের সম্মুখ থেকে শোক র্যালি বের করা হবে।
৫ আগস্টের পর থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে-জামায়াত: ইসকন সমর্থকদের হামলায় নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মৃত্যুতে দোয়া মাহফিল করেছে চট্টগ্রাম নগর জামায়াত। মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে দোয়া পরিচালনা করেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী।
শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকেই একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ক্রমাগত চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবেই সাইফুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে। ইসকন নামধারী সন্ত্রাসীরা সোমবার চেরাগী পাহাড় মোড়ে মঙ্গলবার আদালত ভবন চত্বরে তান্ডব চালানোর জন্য জড়ো হলেও প্রশাসন আগে থেকে কোনো ভূমিকা পালন করেনি। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং জনসাধারণকে শান্ত থাকার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
চট্টগ্রাম আদালতের ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশনে আগুন: আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যায় সহায়তা করার অভিযোগে চট্টগ্রাম আদালতের ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশনের অফিসের (মুন্সি সমিতি) নথিপত্রে আগুন দিয়েছেন আইনজীবীদের একাংশ। বুধবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ আইনজীবীদের অভিযোগ-মঙ্গলবারের তান্ডবে বেশিরভাগ ক্লার্ক জড়িত ছিল। ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুরের পর ইসকন সদস্যরা তাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান আটকে বিক্ষোভ করেন। এ সময় মুন্সি সমিতির সদস্যরা নিজেদের পোশাক এবং খাবার পানি বিক্ষোভকারীদের সরবরাহ করেছেন। এছাড়া তারা উস্কানিমূলক বিভিন্ন পোস্টও দিয়েছেন ফেসবুকে।